সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪৭ অপরাহ্ন
Notice :
পরীক্ষামূলক আয়োজন চলছে। শীঘ্রই আসছি পূর্ণাঙ্গরূপে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনে সিঙ্গাপুর ও কলকাতা মডেল

আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব / ৪৮ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩

অ) এই তো কয়েকদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে অবহিত হই যে, এ বিশে^ প্রতিবছর হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণে যত মানুষ মারা যায়, তা বাঘ-ভাল্লুক বা সিংহ-হায়না বা বীষধর সর্প নয়, সেটা হলো অতি ক্ষুদ্রজীব মশা। এদিকে ইদানিং পত্র-পত্রিকা খুললেই যেটা চোখে পড়ে, তা হলো ডেঙ্গু জ¦র। এই জ¦র দিনে দিনে মারাত্মক রূপ ধারণ করছে। আক্রান্ত রোগী এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে হাসপাতালে সংকুলান হচ্ছে না। রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক ও নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন। আর মারা যাচ্ছেও কম নয়? এদিকে আক্রান্ত বেশি পুরুষ এবং মৃত্যু বেশি নারী। এ প্রেক্ষাপটে জরুরী অবস্থা জারির প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অনেকে বলছেন, যথাযথভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলে হয়তো মহামারীতে রূপ নিতে পারে। বস্তুত ডেঙ্গু জ¦র এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। আর এই রোগ বর্ষাকালে বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এ বিশে^ ডেঙ্গু জ¦রের উৎপত্তি সম্পর্কে কালভিত্তিক তেমন তথ্য না পাওয়া গেলেও ১৭৭৯ সালের দিকে এর সংক্রমণের কথা জানা যায়। এদিকে এই জ¦রের নাম কেন ডেঙ্গু হলো। সে ব্যাপারে কোন সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে যতদূর তথ্যাদি নিয়েছি; তাতে প্রতিভাত হয় যে, ঝধিযরষর শব্দবন্ধ কা ডিঙ্গা পেপো থেকে এসেছে। এই সোয়াহিলি শব্দ “ডিঙ্গা” খুব সম্ভব স্পেনীয় শব্দ; যার অর্থ দুষ্ট আত্মার কারণে সৃষ্ট রোগ। আর ডেঙ্গু নামটির ব্যবহার শুরু হয় ১৮১৮ সালের পর থেকে। বলতে গেলে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর এই ডেঙ্গু জ¦র বৈশি^ক মারাত্মক আপদে পরিণত হয়। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, এ পৃথিবীতে প্রতিবছর চল্লিশ কোটির উপর লোক আক্রান্ত হয় এবং হাজার হাজার লোক মারা যায়। বস্তুত এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। যেমন- জ্বর; মাথাব্যথা; বমি; পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। আর এ ব্যাপারে পরবর্তী অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। যাহোক, যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে; যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রক্তপাত হয় এবং রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায়। একই সঙ্গে রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। আর অবস্থাভেদে এমন দাঁড়ায় যে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। তখন রোগীকে বাঁচানো দূরহ হয়ে উঠে। পূর্বেই বলেছি যে এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। তবে পুরুষ এডিস মশা নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কয়েক প্রজাতির এডিস স্ত্রী মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। এর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি স্ত্রী মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। উল্লেখ্য যে, এই ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো যে, ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে; সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে এবং কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করলেও পরবর্তীতে আরও ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এদিকে কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে ডেঙ্গু জ¦র হয়েছে কিনা, তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণত ভাইরাসের আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখে ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় প্রাথমিক যে পরিবর্তন ধরা পড়ে, তা হলো শে^ত রক্তকোষ কাউন্টে হ্রাস, অনুচক্রিকার হ্রাস এবং মেটাবেলিক অ্যাসিডোসিস। এদিকে ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রান্ত শতকরা ৮০ ভাগ রোগী উপসর্গবিহীন এবং অবশিষ্ট শতকরা ২০ ভাগের মধ্যে ৫ ভাগ জটিল ও প্রাণঘাতি হয়ে থাকে। সাধারণত আক্রান্ত হওয়ার ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে উপসর্গ আকারে প্রকাশ পায়। আর বড়দের চেয়ে বাচ্চাদের উপসর্গের তীব্রতা তুলনামূলক কম হলেও বাচ্চারাই অধিক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এর মধ্যে জানা গিয়েছে যে, ডেঙ্গুর লক্ষণ বদলে যাওয়ায় এই জ¦র হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ার জন্য চিকিৎসা নেয়া সহ হাসপাতালে বিলম্বে যাওয়ার কারণে অনেক রোগী মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এদিকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু জ¦রকে প্রাবল্য অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রেডে বিভাজিত করেছে।
আ) যেহেতু এটি ভাইরাস জনিত রোগ। সেহেতু এ বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য ভাইরাস সংক্রান্ত সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক বলে মনে করি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে ভাইরাস  শব্দটি; যার অর্থ হলো “বিষ ”। এটি এমন একটি রহস্যময় বস্তু, যা না-জীব, না-জড়। তবে এটি উল্লিখিত দু’টির মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করে থাকে। ভাইরাস অ-কোষীয় এবং অতি আণুবীক্ষণিক ও প্রোটো-প্ল্যাজমাবিহীন রাসায়নিক পদার্থ বিশেষ। তাছাড়া প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডের সমন্বিত রূপ (ওহঃবমৎধঃবফ) মাত্র। এর কণিকাসমুহ পরিশ্রুত  ও কেলাসিত করা যায়। ভাইরাস মাত্রই অণু ও প্রোটিন দিয়ে গঠিত। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার মতো ভাইরাসও জীব কোষ ছাড়া বাঁচে না। এটি পোষক দেহে পরজীবী রূপে বাস করে এবং এর বাইরে জড় স্ফটিক  রূপে থাকে এবং এ ভাইরাসের পোষক হিসেবে উদ্ভিদ, প্রাণী, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ইত্যাদি এ যাবৎ চিহ্নিত হয়ে হয়েছে। ১৮৮২ সালে রুশ বৈজ্ঞানিক আইভানোভসকি সর্বপ্রথম তামাকের পাতার মোজাইক রোগের কারণ হিসাবে ভাইরাসের  উপস্থিতি প্রমাণ করেন এবং ১৯৩৫ সালে ড. স্টানলি কেলাসিত করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মিঃ এন ডব্লিউ পিরি এবং মিঃ বাদন ভাইরাস যে প্রোটিন এবং নিউক্লিক এসিড দিয়ে গঠিত, তা বেশ কিছুকাল গবেষণার পর প্রমাণ করতে পুুরোপুরি সক্ষম হন। রহস্যময়ী এ ভাইরাসের মাধ্যমে যে রোগের প্রাদুর্ভাব হয়, তার রয়েছে আজব ধর্ম । সবসময় এবং সহজেই এটি ভোল ও স্বরূপ পাল্টাতে পারে। সাধারণতঃ প্রত্যেকটি জীব বেড়ে উঠার সাথে সাথে জীনগত  ক্রমোজমে কিছু পরিবর্তন হয়। প্রকৃতিগত নিয়মে কোষ বিভাজনের প্রাক্কালে এর মধ্যে  প্রতিলিপি  তৈরী হয়। তখন ডি এন এ ক্ষতিগ্রস্থ  হয়। তবে স্বাভাবিকভাবে আবার রিপেয়ার তথা সংশোধন হয়। ফলশ্রুতিতে বৈসাদৃশ্যের কোন অবকাশ থাকে না। কিন্তু এই জ্বরের ভাইরাসে এর প্রতিলিপি  তৈরির সময় ক্ষতিগ্রস্থ হলে, তা আর সংশোধিত তথা মেরামত হয় না। এ অসংশোধিত ডিএনএ, ঠাকুর মার ঝুলির মাথা কাটা রাক্ষসের ন্যায় কর্মপরিধি ও প্রকৃতি সহ ভয়াবহ হাজার হাজার রাক্ষসের রূপ নেয় এবং সৃষ্টি হয় নতুন ধরনের নেতিবাচক ভাইরাস। তখন সংক্রমণ তথা ভয়াল পরিসর নিয়ে আক্রমণ করে অন্য জীবকে তথা পরাক্রমশালী মানুষ নামের জীবকেও। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মিঃ পিটার মেডাওয়ার দুঃখ ও ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে, “ভাইরাস হলো প্রোটিনের মোড়কে বাঁধা দুঃসংবাদ  উল্লেখ্য যে, এতে দু’ধরনের এন্টিজেনিক অংশ রয়েছে। এ যাবৎ ১৩ ধরনের ঐ (হিমএগুটিনিন) এবং ৯ ধরনের ঘ (নিউর‌্যাসিনাডেজ) প্রোটিনের সনাক্তকরণ ও শ্রেণী বিভাজন সম্ভব হয়েছে। এদিকে এইচ (ঐ) ভাইরাসকে কোষের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়, যার ফলে ভাইরাসটি সংক্রমণপূর্বক নিজেকে বিবর্তিত করার প্রয়াস পায়। অপরটি ৯ এন (ঘ) কোষের ভিতর নিজেকে বহুগুণ তথা জ্যামিতক গতিতে বাড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে কোষ থেকে বেড়িয়ে আসতে সহায়তা করে এবং এই ভাবে শক্তি অর্জন করার পর গর্বিত মানুষ নামের প্রাণীকে নাস্তানুবাদ করে ফেলে, যা তো সবাই বর্তমানে অনুভব করতে পারছেন।

দ্বিতীয় পর্ব
ই) দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্যতম প্রধান প্রাথমিক ধারক হলো মনুষ্য জীব। তাই আক্রান্ত মানুষ থেকে এডিস মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। বস্তুত একবার কামড়ালেই সংক্রমণ হতে পারে। উল্লেখ্য যে, স্ত্রী মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের রক্ত পান করে পেটে বহন করে এবং নিজেও সংক্রমিত হয়। প্রায় ৮-১০ দিন পর উক্ত ভাইরাস মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে আছে লালাগ্রন্থি। তৎপর লালাগন্থি থেকে এর লালায় চলে আসে। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মশা আক্রান্ত হলেও এর উপর ক্ষতিকর কোন প্রভাব পড়ে না। উল্লেখ্য, এডিস ইজিপ্টি স্ত্রী মশা মানুষের কাছে থাকতে পছন্দ করে বিধায় কাছাকাছি জলাধারে ডিম পাড়ে। তাছাড়া অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণীর চেয়ে মানুষের রক্ত ওদের কাছে প্রিয়। যাহোক, মশা কামড়ানোর প্রাক্কালে লালার মাধ্যমে এই ভাইরাস ত্বকের ভেতর প্রবেশ করে। তৎপর উক্ত ভাইরাস তার বাসস্থান পাকা করে নেয় ও শে^ত রক্তকোষে ঢুকে পড়ে। আর যখন রক্তকোষগুলো শরীরের সর্বত্র চলাচল করে। তখন সেগুলোর মধ্যে এই ভাইরাস প্রজনন কার্য চালায় এবং বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। এই সময়ে এর প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ শে^ত রক্তকোষগুলো বহুসংখ্যক সিগন্যালিং প্রোটিন তৈরী করে। তখন এর বর্হিপ্রকাশ হিসেবে মানবদেহে জ¦র সহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
ইতিপূর্বে উপসর্গ নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত করলেও সম্যক ধারণার জন্য বিশদভাবে আলোচনা করা সমীচীন বলে মনে করি। উল্লেখ্য যে, ডেঙ্গু উপসর্গের বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ জ্বর হওয়া; মাথাব্যথা; মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা এবং র‌্যাশ বেড়োনো। অনেকে ডেঙ্গু জ¦রকে হাড় ভাঙ্গা জ¦র বলে অভিহিত করে থাকেন। কেননা মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগ স্থলে এবং মেরুদণ্ড ও কোমরে বেশ ব্যথা হয়। আর সামগ্রিকভাবে এই উপর্সগ তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত: যেমন- র) প্রাথমিক, রর) প্রবল এবং ররর) আরোগ্য।
র) প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অত্যধিক জ্বর, প্রায়শ ৪০০ সেলসিয়াস (১০৪০ ফা:) এর বেশি। সঙ্গে থাকে সাধারণ ব্যথাসহ মাথাব্যথা। এটি সাধারণতঃ দুই থেকে সাতদিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে ৫০% থেকে ৮০% উপসর্গের আদলে র‌্যাশ বেড়োয়। আর উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে লাল ফুসকুঁড়ি হিসাবে দেখা দেয়, অথবা হামের মতো র‌্যাশ দেখা দেয়। তাছাড়া কিছু ছোট ছোট লাল বিন্দু দেখা দেয়; যেগুলি ত্বকে চাপ দিলে অদৃশ্য হয় না; যার কারণ হচ্ছে ভগ্ন রক্তবাহী নালী। এদিকে কারোর মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প পরিমাণ রক্তপাতও হতে পারে।
রর) আর কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অসুখটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যার কারণে ভীষণ জ্বর হয় এবং তা সাধারণত এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। রোগীদের রক্তপ্রবাহে তারল্যের পরিমাণ কমে যায়; প্লাটিলেট (রক্তের প্লাটিলেটের স্বাভাবিক মাত্রা দেড় লাখ থেকে শুরু করে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত) দ্রুত কমতে থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়। এই পর্যায়ে শরীরে পানি জমা ও বমিসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকলতা এবং প্রবল রক্তপাত হয়। এক্ষেত্রে যাদের আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্যান্য সেরোটাইপ এর সংক্রমণ ঘটেছে (“সেকেন্ডারি ইনফেকশন”) তারা বর্ধিত বিপদের মধ্যে থাকে। আর এই ধরনের অবস্থা ৫% রোগীর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
ররর) এ পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে রক্তপ্রবাহে তরলতা ফিরে আসে। আরোগ্যর ক্ষেত্রে এই উন্নতি হয় চমকে দেবার মতো। কিন্তু প্রচণ্ড চুলকানি ও হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হতে পারে এবং অন্য রকম গুষ্টি সহ র‌্যাশও বেড়োতে পারে। তাছাড়া ক্লান্তির অনুভূতি অনেক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। আর এই ভাবে আরোগ্য দিকে চলে যায়।
তৃতীয় পর্ব
ঈ) বস্তুতঃ ডেঙ্গু জ¦রের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। রোগের উপসর্গ বা লক্ষণের উপর চিকিৎসা নির্ভর করে। বাড়ীতে নিয়মিত দেখাশোনার সঙ্গে ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি বেশি বেশি তরল খাবার যেমন- স্যালাইন, ডাবের পানি, লেবুর সরবত, ফলের রস, স্যুপ, ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। বেশি ব্যাথা হলে প্যারাসিটামাল খাওয়ানো যাবে। অন্য কোন ব্যাথানাশক ঔষধ সেবন করা যাবে না। আর ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া পুরোপুরি নিষেধ। অবস্থাভেদে বেগতিক দেখলে হাসপাতালে ভর্তি করে ইন্ট্রাভেনাস থেরাপি বা ব্লাড ট্রান্সফিউশন পর্যন্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। প্রয়োজনে রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। আর মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হবে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিরেকে কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও নন ষ্টেরয়েডাল প্রদাহ প্রশমী ঔষধ সেবন করা যাবে না। কেননা এতে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন স্বীকৃত টিকা (ভ্যাকসিন) নেই। তাই রোগ যাতে না হয়, সেই দিকে নজর দেয়া জরুরী। এক্ষেত্রে ইংরেজিতে একটি প্রবচন আছে, তাই প্রতিরোধের আওতায় জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং এর কামড় থেকে সুরক্ষা থাকাই বড় কথা। সেহেতু মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশ বিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্যে এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন পাত্র বা আধার যেমন- কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, ছাদ, পুরানো বাড়ীর ধ্বংসাবেশ, নতুন ইমারতের নির্মাণ স্থান, ভাঙ্গা গাড়ী, ফুলের টব, বৃষ্টির অব্যবহিত পর রাস্তার জমে থাকা পানি, পানির মিটারের চেম্বার, ছোট ছোট ডোবা-নালা ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। অবশ্য এর মধ্যে ঢাকা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এডিশ মশার লার্ভা পাওয়ায় পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত কর্তৃক জরিমানা করা হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে বাড়ীর আশে-পাশে যাতে মশা জন্মাতে না পারে সেদিকে খেয়াল করতে হবে। তাছাড়া মশারি টানানো সহ শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখা যায়, এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। এতদ্ব্যতীত যারা আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল, তাঁরা এরোসল বা সমজাতীয় স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন।
উ) সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের বাংলাদেশে ২০০০ সালের দিকে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। আর কয়েক বছর আগেও ডেঙ্গু প্রধানত ঢাকা রাজধানীতে সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ এখন পুরো দেশেই ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। উল্লেখ্য যে এডিস মশার ঘনত্ব, প্রজননস্থল, পুরোনো চার সেরোটাইপের সঙ্গে এ বছর নতুন মিউটেশনের কারনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং রোগের নতুন নানা উপসর্গ নিয়ে ডেঙ্গুর ভয়ানক রূপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই গত বছরের চেয়েও এ বছর খারাপ হওয়ার আশঙ্কা মনে করা হচ্ছে। এদিকে গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। আর এ বছর জুলাইয়ের শুরুতেই এটি চরমে পৌঁছে গেছে। যদি জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই প্রাদুর্ভাব অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকে, তাহলে এটিকে সামাল দেয়া মুশকীল হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হয়।
আসলে তুলনামূলক কম হলেও ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। তাই এটি নিয়ন্ত্রণে সারা বছর ধরে যে ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটছে বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেঙ্গু ঢাকা শহরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর সারা দেশের কথাতো বাদই দিলাম। বস্তুত আমরা কাজের চেয়ে প্রচারে বেশি বিশ^াস করি। এইতো ড্রোনের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র এবং লার্ভা খোঁজার ফুটেজ পর্যবেক্ষন করে কত দূর পর্যন্ত এগিয়েছে, তা হয়তো নাগরিকদের কাছে অজানা রয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, “ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া” দিয়ে ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ ৭০ শতাংশ কমিয়েছে। আর এটি অনুসরন করে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্য বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু এটি সময় ও খরচসাপেক্ষ। তাছাড়া অতিমাত্রায় ঘনবসতি হওয়ায় বাংলাদেশে হয়তো এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা ঠিক হবে না; বরং আমরা কলকাতা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মডেল অনুসরণ করতে পারি। তবে কলকাতা ও মালয়েশিয়ার মডেলটি আমাদের উপযোগী হবে বলে মনে করি। তাই কলকাতা ও মালয়েশিয়ায় মডেলটি প্রতিরোধের ব্যাপারে যে ভাবে কাজ করে থাকে, তা কিছুটা তুলে ধরা হলোঃ
এ প্রেক্ষাপটে তারা একটি র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠন করে, যাদের মধ্যে আবার ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। একেক গ্রুপের কাজের ধরনও ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে মৌসুমের শুরুতেই গ্রুপগুলো তৎপর হয়ে থাকে। তাদের কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জনসম্পৃক্ততা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি, সমাজের নেতা এবং বিভিন্ন সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের মডেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি ও মশার সম্ভাব্য প্রজনন স্থানগুলো চিহ্নিত করার জন্য জনগণকে ক্ষমতায়ন করা হয়ে থাকে। তাছাড়া শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়া হয়, যা প্রাদুর্ভাবের প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এ ছাড়া তাদের একটি টিম, কোনো রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেই সিটি করপোরেশনকে অবহিত করে। সিটি করপোরেশন ওই আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আশপাশে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ওষুধের মাধ্যমে সব মশার প্রজনন ও লার্ভা ধ্বংস করে। আর এই মডেল অনুসরন করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে সিঙ্গাপুরে যে ভাবে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (এনইএ) কর্মীরা নিয়মিত ঘরে ঘরে ও পাবলিক স্পেসে ডেঙ্গু মশার জন্মস্থল খুঁজে ধ্বংস করে। সিঙ্গাপুরের আইন অনুসারে নির্মাণকাজের সময় পেস্ট কন্ট্রোল অফিসার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিতে হয়, যাদের কাজ প্রতিদিন সকালে মেঝে পরিষ্কার করা এবং দুই সপ্তাহে একবার মশকরোধী তেল প্রয়োগ করা, যেন এসব সাইটে জমা পানিতে মশা জন্মাতে না পারে। তাছাড়া বাঁয়ু চলাচল বন্ধ করে মশার লার্ভা মারা হয়ে থাকে। আর ডেঙ্গু উপদ্রুত এলাকাগুলোকে ‘ডেঙ্গু ক্লাস্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; সেখানে কোনো আবাসিক এলাকায় ১৪ দিনের মধ্যে ১৫০ মিটার এলাকায় দুই বা ততোধিক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে সেটিকে ‘ডেঙ্গু ক্লাস্টার’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১০ জনের কম হলে হলুদ, বেশি হলে লাল ব্যানার টানিয়ে সংস্থার ওয়েবসাইটে এলাকাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া হয়। এদিকে সিঙ্গাপুর জুড়ে ৭০ হাজার গ্রেভিট্র্যাপ (ডিম পাড়তে ইচ্ছুক স্ত্রী এডিস মশা আটকানোর বিশেষ ফাঁদ) স্থাপন করেছে সরকার। এক্ষেত্রে উক্ত ফাঁদের মধ্যে আটক মশার তথ্য থেকে ধারনা করা যায় যে, কোন এলাকায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেশি হচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে বলতে চাই যে সিঙ্গাপুর মডেল অনুসরন করা সম্ভব না হলেও আমরা কলকাতা মডেল অনুসরন করতে পারি। এখানে এই মর্মে একটি কথা স্বভাবতই এসে যায়; যা হলো করোনা ভাইরাসের বিষয়টি অদৃশ্য এবং মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছোঁয়াছে। কিন্তু ডেঙ্গুর ব্যাপারটি দৃশ্যমান। আর এত ভয়ানকও না। তাই এ ব্যাপারে না পারার কারন দেখি না। আসলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনের ব্যাপারে সরকারের কেবল একক দায়িত্ব নয়। জনসাধারনের দায়িত্ব কোন অবস্থায় খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব জনসাধারনের ৭০% এবং সরকারের ৩০% বলে বাস্তব অবস্থাভেদে মনে করা হয়। তাই সবাই সবার স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে; কারও এককভাবে দোষ না দিয়ে আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগুতে হবে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে, পাশের প্রতিবেশী দেশের কোলকাতা যদি পারে, আমরা পারবো না কেন?


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর