বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৬ পূর্বাহ্ন
Notice :
পরীক্ষামূলক আয়োজন চলছে। শীঘ্রই আসছি পূর্ণাঙ্গরূপে।

জেলেদের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য সমবায়

আতিকুর রহমান / ৭৭ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৩

 

নদীমাতৃক বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ জেলে। বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মৎস শিকার,প্রক্রিয়াকরন প্রক্রিয়ায় জীবীকা নির্বাহ করে। কথায় আছে জল যার জলা তার। কিন্ত তা এখন কথার কথা। জেলেরা এখন জলের ্ইজারাদারের হাতে নিগৃহীত। মধ্যস্বত্ত্বভোগী সুদের কারবারি মহাজনের দ্বারা নিস্পেষিত। জলাশয়,নদী,সাগরে জাল ফেলে মাছ কম পাক আর বেশি পাক ইজারাদারকে তার নির্ধারিত টাকা দিতে হবে। আবার অভাবে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার কারনে অল্প দামে মাছ মহাজন নিয়ে যায়। সারাদিন কষ্টক্লেশ করে মাছ শিকার করে না পারে পরিবার পরিজন নিয়ে মাছ খেতে আর না পারে মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চালাতে। আবার নদী সমুদ্রে এখন মাছও কম। কৃত্রিম জলাশয়ে মাছ চাষ করবে সেই আর্থিক সামর্থ্যও নেই জেলেদের। বর্তমানে প্রাকৃতিক উন্মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে কৃত্রিম জলাশয়ে মৎস উৎপাদন বেশি হয়। তাই জেলেদের জীবন জীবিকা বিপন্ন । এমতাবস্থায় দেশের পশ্চাদপদ অনগ্রসর জেলে সম্প্রদায়ের সমবায়ের আওতায় এনে সুসংগঠিত করে তাদের জীবন জীবিকার উন্নতি সাধন করা যায় সহসাই। জেলে সমাজ সমবায় নীতির আওতায় উন্মুক্ত প্রাকৃতিক জলাশয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে যৌথভাবে মৎস শিকার করতে পারে। আবার সমবেতভাবে কৃত্রিম জলাশয়ে মৎস চাষ করতে পারে। এমনকি জেলে সমাজ তাদের সম্মিলিত পূঁিজ দিয়ে মৎস প্রক্রিয়াকরন কারখানা স্থাপন করে মৎস রপ্তানি ব্যবসায়ও সম্পৃক্ত হতে পারে।জেলেদের সমবায় সমিতির নিকট উন্মুক্ত জলাশয় ইজারা দেয়া হলে মধ্যস্বত্ত্বভোগী কর্তৃক শোষনের শিকার হবেনা। তাছাড়া,জেরেরা নিজেদের সমবায় সমিতিতে নিয়মিত সঞ্চয় তহবিল থেকে নিজেদের প্রয়োজনে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারবে। ফলে চড়া সুদের কারবারি মহাজনের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পাবে। সমবায়ের মাধ্যমে জেলেরা ফিরে পাবে স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী জীবন। কেননা,সমবায় হচেছ গণতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। নিজেদের জন্যে নিজেদের দ্বারা পরিচালিত। সদস্যরাই সমবায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। সদস্যদের শেয়ারের পরিমান কম বেশি যাই হোক অধিকার সমান। এক সদস্য এক ভোট নীতি। যে নীতি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনুসরন করা হয়না।সমবায়ে কেউ কাউকে শোষন করতে পারেনা। শোষন করার সুযোগ নেই। এখানে সবাই মালিক কেউ কর্মচারী নয়। সমবায় নিজেকে নিজে পরিচালনা করতে শেখায়। সমবায় উদ্যেক্তা হতে উৎসাহ যোগায়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মৎস সমবায়ের উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। সরকার-সমবায় অংশীদারিত্বে মৎস সমবায়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেশে জেলেদের জীবন জীবিকা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস সমবায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। যা এখন ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় পেয়েছে। মৎস্য জীবীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মৎস্য ধরার সরঞ্জাম ক্রয় ও ন্যায্য মূল্যে সদস্যদের মধ্যে বিতরণ, সদস্যদের কল্যাণে মৎস্য শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং জলমহাল অধিগ্রহণ করা সহ বিভিন্ন মহৎ উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সালের ১২ মার্চ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মৎস্য ক্ষেত্রের শীর্ষ সমবায় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি: প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯১টি কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি এর সদস্য ছিল। প্রায় ৯ হাজার প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমিতি ছিল। জাতীয় সমিতি আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য শিকারের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে ফিশিং বোটের মেশিন, যন্ত্রপাতি, জাল তৈরীর নাইলন টায়ার কর্ড এবং বিভিন্ন ফিশিং গিয়ার্স আমদানী করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মৎস্য শিকারের প্রচলন করে জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। এমনকি দেশে দু’টি হিমায়িত মৎস প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপন করে বিভিন্ন দেশে মাছ রপ্তানী করে সুনাম অর্জন করেছিল।

মৎস্য সমবায়ের গৌরবের কথা এখন শুধুই ইতিহাস। প্রাথমিক মৎস্য সমবায় সমিতি সমূহের বলতে গেলে এখন আর অস্তিত্ব নেই। কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলোও নামমাত্র টিকে আছে। অধিকাংশ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির ভূসম্পদ রয়েছে। কিছু সমিতির নিজস্ব কার্যালয় আছে। তবে কোন কার্যক্রম না থাকলেও প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকায় জাতীয় মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। অন্ন থাকলে অন্ন ধ্বংস করার লোক প্রয়োজন হয়। তাই সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা কমিটিও রয়েছে। এই সম্পদ কার্যত: মৎস্যজীবী বা সমবায়ের কোন কাজে আসেনা। একটি গোষ্ঠির আয় রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে মাত্র।
চট্টগ্রামের পাথর ঘাটায় হুকুম দখলমুলে প্রাপ্ত ১.৩৪৩ একর ভূমিতে সমবায় পাইকারী মৎস্য বাজার। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাজারটি এখনো চালু রয়েছে। পাথর ঘাটায় হুকুম দখলমুলে প্রাপ্ত ০.২১০ একর ভূমিতে ৩৬টি দোকান সমন্বয়ে ফেরোসিমেন্ট মার্কেট। যা ২০০১ সালে স্থাপিত এবং ভাড়ায় চালিত হচ্ছে। পাথরঘাটায় হুকুম দখলমূলে প্রাপ্ত ০.৫২০ একর জায়গায় সমবায় বিপণী কেন্দ্র, জালবুনন কারখানা ও গুদাম। মার্কেট ও গুদাম চালু থাকলেও জালবুনন কারখানা বন্ধ রয়েছে। পাথরঘাটায় লীজপ্রাপ্ত ২.৬১০ একর ভূমির অংশ বিশেষে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা ও বরফকল। ২টি হিমাগার সমন্বয়ে ১ ইউনিট বিশিষ্ট মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাটি ভাড়ায় চালিত হচ্ছে।
পাথরঘাটায় লীজপ্রাপ্ত ২.৬১০ একর ভূমির অংশ বিশেষে স্থাপিত ১০টন সমবায় বরফকল। সমস্যা সংকুল বরফ কলটি ভাড়ায় চালিত হচ্ছে।
পাথরঘাটায় লীজেপ্রাপ্ত ২.৬১০ একর ভূমির অংশবিশেষে স্থাপিত ৩৩টন সমবায় বরফ কল। সমস্যাগ্রস্ত বরফ কলটি ভাড়ায় চালিত হচ্ছে। খুলনার যুগিহাটিতে খরিদকৃত ১.৬৫ একর ভূমিতে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। ১৯৮৮ সাল থেকে কারখানা বন্ধ রয়েছে। ঢাকার কেরানিগঞ্জের চরমিরেরবাগে খরিদকৃত ১.০০ একর ভূমিতে ৩৩ টন বরফকল। বরফকলটি কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
রাঙ্গামাটির কাঠালতলিতে খরিদ ও বন্দোবস্তপ্রাপ্ত ০.৪৫৪ একর ভূমিতে বরফকল ও দোকানপাট। এটি সচল ও লাভজনক এখনো। যশোরের নিউমার্কেটে খরিদকৃত ০.৩০৪ একর ভূমিতে ১০ টন বরফকল। ১৯৮৭ সাল থেকে বরফকলটি বন্ধ আছে। মাদারীপুরের ঘোসকুলে ০.১৪ একর খরিদকৃত ভূমিতে ১০ টন বরফকল। ১৯৯৬ সাল থেকে বরফকলটি বন্ধ আছে এবং পটুয়াখালির কালাইয়া বন্দরে খরিদকৃত ০.৩৩০ একর ভূমিতে ১০ টন বরফকল। ১৯৯৯ সাল থেকে বরফকলটি বন্ধ রয়েছে। সমিতির মোট জমির পরিমাণ ৬.১৪৪৫ একর এবং দালানের সংখ্যা ২০টি। সমিতির যেমন রয়েছে প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ তেমনি রয়েছে নগদ অর্থ আয়ের সুযোগ। কিন্তু সমিতিতে দীর্ঘদিনের দূর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে রয়েছে প্রচুর মামলা মোকদ্দমা, রয়েছে ঋণের বোঝাও। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সম্পদ বেহাত বেদখল হয়ে যেতে পারে।

সমবায়ের মূল স্তম্ভ প্রাথমিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে। বিদ্যমান নিস্ক্রিয় সমিতিগুলো সক্রিয় করার পাশাপাশি নতুন করে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গড়ে তুলতে হবে। এজন্যে সমবায় অধিদপ্তরকে একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে মৎস অধিদপ্তর ও মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতীয় সমিতি এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রাথমিক মৎস্যজীবি সমিতি গঠিত হলেই প্রাণ ফিরে পাবে কেন্দ্রীয় সমিতি। তেমনি জাতীয় সমিতিও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। জাতীয় সমিতির সমুদয় সম্পদ মৎস্যজীবীদের কল্যাণে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। বন্ধ জাল বুনন কারখানা, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা চালু করতে হবে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী জেলে সমবায়ের উদ্যেগে কৃত্রিম জলাশয়ে মৎস চাষের প্রকল্প গ্রহন করতে হবে। চালু কারখানা আধুনিকায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজন অনুসারে ঋণ ও অনুদান প্রদান করতে হবে। নিজস্ব তহবিলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে সম্পদের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ নেয়া অথবা সমবায় অংশিদারিত্বের আওতায় দেশের প্রতিষ্ঠিত সমবায় সমিতির নিকট শেয়ার বিক্রয় করা যেতে পারে। মৎস্য সমবায়ের পুনর্জাগরণ ঘটলে একদিকে জেলেদের জীবন জীবিকায় স্বচ্ছলতা যেমন আসবে তেমনি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে। অন্যদিকে মৎসে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণ মৎস্য রপ্তানী করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।মৎস সমবায় কোরিয়া,জাপান,ভারত সহ বিভিন্ন দেশে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি স্ব স্ব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশেও যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যেগ গ্রহন করা হলে মৎস সমবায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোরিয়া সহ অন্যান্য দেশের অনুরুপ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সমবায় গবেষক

 

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর