কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সমবায় চাষাবাদ

কৃষি ভূমির মালিক বা ভাগ চাষীদের সমবায় নীতিতে সম্মিলিত চাষাবাদ বা যৌথ খামার পরিচালনাই সমবায় চাষাবাদ। এক্ষেত্রে ভূমির মালিক ও ভাগচাষী কৃষকের পৃথক সমবায় সমিতি হতে পারে আবার সমন্বিত কৃষি সমবায়ও হতে পারে। বা এক গ্রাম এক কৃষি সমবায় সমিতি হতে পরে। গ্রাম ভিত্তিক কৃষি সমবায় সমিতি সমগ্র গ্রামের আবাদযোগ্য জমির আইল(সীমানা বিভাজক) অপসারন করে অখন্ড জমিতে চাষাবাদ করবে। এতে আইল অপসারনের কারনে চাষযোগ্য জমির পরিমান বাড়বে। ফলে ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। একটি গবেষণা মতে আইলে যে পরিমান জমি নষ্ট হয় তা বাংলাদেশের একটি ছোট জেলার সমপরিমান। অতএব আইল প্রথা বাদ দিয়ে যৌথ খামারে চাষাবাদ হলে কি পরিমান ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে তা সহসাই অনুমেয়। যৌথ খামারে উৎপাদিত ফসল সমবায়ের সদস্যদের মধ্যে সেবার অবদান অনুসারে বন্টিত হবে। এখানে সম বন্টনের নীতির স্থলে ন্যায্য বন্টনের নীতি অনুসরন করা হয়। সমবায়ের গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরন করা হলে এই ব্যবস্থায় করো বঞ্চিত বা শোষিত হওয়ার সুযোগ নেই। যৌথ কৃষি সমবায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-মালিকানার অধিকার স্বীকৃতি,স্বেচ্ছা সদস্য পদ,গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা,সেবার অবদান অনুযায়ী ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি ও সমাজ সেবার প্রবিধান। সমবায কৃষির কিছু সমস্যাও পরিলক্ষিত হয়। যেমন -দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব,ঋণ সংকট, বৃহৎ ভূমি মালিক ও প্রভাবশালী সদস্য কর্তৃক ক্ষুদ্র ভূমি মালিক ও নিরীহ সমবায়ীদের শোষণ প্রচেষ্টা, বড় সমবায়ের দ্বারা ছোট সমবায়ের বঞ্চনার আশংকা ও মুলধন সংকট। এক্ষেত্রে সমবায়ের গণতান্ত্রিক নীতি পরিপূর্ণভাবে অনুসরন করা হলে মুলধন ব্যতিত অন্য সমস্যাগুলো সহসাই উত্তরন করা সম্ভব। আর সমবায়ে মুলধন সমস্যা বরাবরই একটি ফ্যাকটর। তবে যে সকল দেশে সরকারি অর্থ সহায়তা আছে সে সকল দেশে সমবায়ে মুলধন সমস্যা হয়না। সরকার-সমবায় অংশিদারিত্ব থাকলে মুলধন সমস্যা হবে না।
সারা বিশে^ প্রায় ১.২ মিলিয়ন কৃষি সমবায় রয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রে ২১০০ কৃষি সমবায়ে ২ মিলিয়ন সমবায়ী কৃষক সম্পৃক্ত। কৃষি সমবায়ে রাশিয়ার বাহিরে ডেনমার্ক,নেদরল্যান্ড ও ভারত শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। সমবায় ভূমি খ্যাত ডেনমার্কের সকল কৃষক সমবায়ের সাথে সম্পৃক্ত। ডেনমার্কের চাষাবাদযোগ্য প্রায় ৯০ ভাগ ভূমি সমবায়ের আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইউরোপ আমেরিকা সহ অনেক দেশে কৃষি সমবায় সাফল্যের সাথে কার্যক্রম পরিচালনা করে কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্ব স্ব দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলছে।
ভুমিহীন,ভাগচাষী, দরিদ্র, একাডেমিক অশিক্ষিত কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করে উন্নত চাষাবাদ প্রয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ এবং যৌথ কৃষি খামার স্থাপন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সমবায়ের অবদান অসামান্য। ইউরোপ আমেরিকায় কৃষি সমবায় ও যৌথ কৃষি খামার সফলভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে ২ শত বছর আগে থেকেই। বাংলাদেশে ইউরোপ আমেরিকার মত সফল না হলেও কৃষি সমবায়ের সূচনা হয়েছিল ঠিকই্ । ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায় নি বলে যা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। বৃটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ৮০’র দশক পর্যন্ত কৃষি সমবায়ের সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত থাকে। গ্রাম ভিত্তিক কৃষি সমবায় গড়ে উঠে, তাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে বৈপ্ল¬বিক পরিবর্তন সূচিত হয় ড. আখতার হামিদ খান প্রবর্তিত দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধত্বি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। ১৯৫৯ সালে কুমিল¬া পদ্ধতি নামে পরিচিত দ্বি-স্তর সমবায় কৃষি ক্ষেত্রে নবজাগরণ তৈরী করে। যার ফলশ্রুতিতে ৮০’র দশকের মাঝামাঝি এদেশে প্রথম সবুজ বিপ্ল¬ব সূচিত হয়। দ্বি-স্তর সমবায় বা কুমিল্লা পদ্ধত্বি তৎকালিন সময়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
পূর্বোক্ত কথা এখন কেবলই ইতিহাস। আগে গ্রামের তালগাছে ওপরে থাকতো বাবুই পাখির বাসা আর মাঝামাঝি থাকত কৃষক সমবায় সমিতির সাইনবোর্ড। এখন তালগাছও আগের মত নেই আবার থাকলেও বাবুই পাখির বাসা ঠিকই আছে কিন্তু কৃষক সমবায় সমিতির সাইনবোর্ড আর নেই। আর যদি সাইনবোর্ড থাকেও তাহলে সমিতির কার্যক্রম বাস্তবে নেই। তবে গোয়ালে গরু না থাকলেও কাজির কিতাবে লম্বা ফিরিস্তি ঠিকই আছে। কৃষি সমবায়ের তত্ত্বাবধায়ক ও সমন্বয়ক বিআরডিবি’র নথিপত্রে ৮৮৭২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক কৃষক সমবায় সমিতির (কেএসএস) কথা বলছে। সমিতি নাম-সর্বস্ব আছে তবে এখন আর ক্রীয়াশীল নেই। অন্যদিকে বিআরডিবি কে এস এস এর কেন্দ্রীয় সমিতি উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় এসোসিয়েশন (ইউসিসিএ) এর সংখ্যা বলছে ৬৯৯টি। এখানে কেএসএস এর তুলনায় ব্যতিক্রম হচ্ছে ইউসিসিএ’র অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। কেননা, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা প্রায় প্রতিটি ইউসিসিএ’র নিজস্ব ভবন আছে। কয়েকটি ইউসিসিএ’র প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও রয়েছে। রয়েছে আয়ের ব্যবস্থা। ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয়না তেমনি ইউসিসিএ গুলোতে রয়েছে ৫-৮ জন নিয়মিত স্টাফ। তবে অধিকাংশ ইউসিসিএ’র কর্মচারিরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেনা।সরকারি বরাদ্দ ও নিজস্ব আয় না থাকায় মাসের পর মাস বেতন বাকি পড়ে আছে।আছে ব্যবস্থাপনা কমিটিও। আই আর ডিপি বিলুপ্ত হয়ে বিআরডিবি গঠিত হলে ইউসিসিএ তে সরকারী বেতন ও পরিচালনা ব্যয় বন্ধ করে দেয় সরকার। মাঝে মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আংশিক স্যালারি সাপোর্ট দেয়া হয়। বাকিটা নিজস্ব আয় থেকে কর্মচারীরা বেতন পান ও ব্যবস্থাপনা কমিটি সম্মানী পান। অন্যদিকে ইউসিসিএ গুলোর সমন্বয়ক ও শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জাতীয় পল¬ী উন্নয়ন সমবায় ফেডারেশনের ১৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী যথার্থ কাজ না থাকলেও রাজস্ব খাত থেকে নিয়মিত বেতন এখনো পাচ্ছেন। ফেডারেশনের কিছু আয়ের ব্যবস্থা থাকায় সব সময় ব্যবস্থাপনা কমিটিও থাকে। আবার ইউসিসিএ সমূহের ভূসম্পদ অব্যবহৃত থাকায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ইউসিসিএগুলো ভূমির খাজনা পরিশোধ না করায় ভবিষ্যতে ইউসিসিএ’র ভূসম্পদ বেদখল হওয়ার আশংকা রয়েছে।
কৃষি সমবায়ের কাঠামো, স্থাপনা, সম্পদ ও সমবায় অধিদপ্তর এবং বিআরডিবি’র বিশাল লোকবল সহ স্থাপনা সবই বিদ্যমান রয়েছে। কেবল সঠিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে সম্ভানাময় কৃষি সমবায় কোমায় রয়েছে। দেশে কৃষি সমবায়ের পুনর্জাগরনের জন্যে প্রতিটি গ্রামে আবার নতুন করে কৃষক সমবায় সমিতি গড়ে তুলতে হবে।বিদ্যমান সমবায় সমিতিগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। এজন্যে বিআরডিবি’র আওতামুক্ত হওয়া জরুরী। কেননা, বিআরডিবি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এনজিও মডেল প্রয়োগ করছে। যে কারণে সমবায় মডেল গুরুত্ব হারাচ্ছে। এই দায়িত্ব সরাসরি সমবায় অধিদপ্তরকে নিতে হবে। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর ও কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজস্ব বাজেটের আওতায় কৃষি সমবায় সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক কৃষক সমিতি গঠিত হলেই ইউসিসিএগুলো প্রাণ ফিরে পাবে। ইউসিসিএ গুলোর বিদ্যমান সম্পদের সদ্ব্যবহার হবে। সমবায় ফেডারেশনও কাজ খুঁজে পাবে। আবার যে সকল ইউসিসিএ’র অর্থ সম্পদ বেশী তারা উদ্বৃত্ত অর্থ দুর্বল ইউসিসিএ কে ঋণ হিসেবে দিতে পারে। সর্বোপরি কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদের যন্ত্রপাতি, সার, বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং নামমাত্র সুদে সহজ শর্তে আবর্তক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।এ জন্যে প্রতি বছর বাজেটে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা আবর্তক ঋণ তহবিল বরাদ্দ করা উচিত। দেশে বিদ্যমান কৃষি সমবায় সমিতি পুনরুজ্জীবিত করে ; জমির আইল পদ্ধতির মাধ্যমে ফসলি জমির অপচয় বন্ধ করে সমবায় খামার বা যৌথ চাষাবাদ ব্যবস্থা চালু করা গেলে কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব সংঘটিত হবে। তাতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি খাদ্য শস্য রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। সর্বোপরি কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে শোষিত বঞ্চিত কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন করা যাবে সহসাই। কেননা, সমবায় হচেছ গণতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। নিজেদের জন্যে নিজেদের দ্বারা পরিচালিত। সদস্যরাই সমবায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। সদস্যদের শেয়ারের পরিমান কম বেশি যাই হোক অধিকার সমান। এক সদস্য এক ভোট নীতি। যে নীতি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনুসরন করা হয়না।সমবায়ে কেউ কাউকে শোষন করতে পারেনা। শোষন করার সুযোগ নেই। এখানে সবাই মালিক কেউ কর্মচারী নয়। সমবায় নিজেকে নিজে পরিচালনা করতে শেখায়। সমবায় উদ্যেক্তা হতে উৎসাহ যোগায়।সমবায় বৈষম্যহীন সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মান করে।
লেখক: সাংবাদিক ও সমবায় গবেষক