শিরোনাম
Notice :
কর্পোরেট বিশ্বায়ন ও নয়া সমবায় আন্দোলন প্রসঙ্গে

সমবায় তত্ত্ব অনেক পুরাতন। দুই শতাধিক কাল আগে ইউরোপের রচডেলে তাতিঁদের মাধ্যমেই মূলত সমবায়ের সূচনা। ক্রমান্বয়ে সমবায় ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যুগের পরিবর্তন ও প্রয়োজনে সমবায়ের পদ্ধতিতে আসে পরিবর্তন। রচডেলে তাতিঁরা যখন সমবায় পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন তখন বিশ্বায়ন বা কর্পোরেট বিশ্বায়নের প্রসঙ্গ ছিলনা। দানবাকৃতির বহুজাতিক কোম্পানীও তখন ছিলনা। কিন্তু বর্তমানে কর্পোরেট বিশ্বায়নের যুগে সমবায় ব্যবস্থার উপযোগিতা উপলব্ধির পাশাপাশি সমবায় ব্যবস্থার পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার বিষয়ও অনুভূত হচ্ছে।
প্রথমে আসা যাক বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে। বিশ্বায়ন কি? আভিধানিক অর্থে বিশ্বায়ন বলতে বুঝায় মানব জীবনের সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয়ের আন্তঃ রাষ্ট্র বিনিময়। সে অর্থে বিশ্বায়নের নেতিবাচক কোন দিক নেই। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে। বিশ্বায়ন আভিধানিক অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন বিশ্বায়ন পরিণত হয়েছে কর্পোরেট পূজিঁর বিশ্বায়নে। বহুজাতিক কোম্পানীর পূজিঁর বিকাশ ও মুনাফার স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া। আর এজন্যেই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সমালোচনা এবং দেশে দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে এবং বিশ্বায়নকে কর্পোরেট বিশ্বায়ন নামে অভিহিত করা হচ্ছে। কর্পোরেট বিশ্বায়ন অভিধাই যথার্থ।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বহুজাতিক কোম্পানীর পূজিঁর বিকাশ, মুনাফা অর্জন, দরিদ্র দেশের স্থানীয় ব্যবসা ও শিল্প ধ্বংস করে বাজার দখলে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে ব্রেটন উডস দানব খ্যাত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। যে কারনে কর্পোরেট বিশ্বায়ন আতংকের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছে। কর্পোরেট পূজিঁর আগ্রাসনে দরিদ্র দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসা ও শিল্প হুমকির মুখে। বিশ্বের সিংহভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় দুইশ বহুজাতিক কোম্পানীর দখলে। আবার কোন কোন বহুজাতিক কোম্পানী মার্জারের মাধ্যমে পূজির্ঁর আকার আরো বড় করে। কোন কোন বহুজাতিক কোম্পানীর বাৎসরিক বাজেট অনেক দরিদ্র দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। অধিকাংশ বহুজাতিক কোম্পানী ইউরোপ আমেরিকা ভিত্তিক। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো যে কেবল তেল, গ্যাস ও অস্ত্রের ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করছে তা নয়। কৃষি, খাদ্যপণ্য সহ প্রায় সব ধরনের ব্যবসাই তাদের নিয়ন্ত্রনে। কৃষি উৎপাদনের বীজ, সার, কীটনাশক কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানীর দখলে। কৃষকের হাতে এখন আর বীজ নেই। জৈবসার বা কীটনাশক ব্যবহারের সুযোগ নেই। বহুজাতিক কোম্পানীর জিএমও, হাইব্রীড বীজ কিনতে যেমন কৃষক বাধ্য তেমনি ফসল উৎপাদনে তাদের সার, কীটনাশকও কিনতে বাধ্য। দশটি বহুজাতিক কোম্পানী সিংহভাগ কৃষি বাণ্যিজ্য নিয়ন্ত্রন করছে। বহুজাতিক কোম্পানীর পণ্যের মান যাই হোক তাদের উৎপাদিত পণ্য তুলনামূলক সস্তা। অনুন্নত দেশগুলোতে সস্তায় বহুজাতিক কোম্পানীর পণ্য বিক্রি হওয়ায় স্থানীয় শিল্প কারখানা বিপাকে। স্থানীয় শিল্প উদ্যোগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলোর বাজার প্রধানত বহুজাতিক কোম্পানীর দখলে। এসব দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প হুমকির মুখে। বৃহৎ শিল্পও চরম প্রতিযোগিতার মুখে বহুজাতিক কোম্পানীর কাছে ধরাশায়ী হতে পারে। গ্রোসারী বা মুদি ব্যবসাও নিরাপদ নয়। সেখানেও বহুজাতিক কোম্পানীর আগ্রাসন। বহুজাতিক রিটেইল চেইনশপ দেশে দেশে তাদের ব্যবসা বিস্তৃত করছে। যাতে বিপাকে পড়ছে ক্ষুদ্র মুদি দোকানী। এসব কারনেই কর্পোটের বিশ্বায়ন নিয়ে আতংক, আশংকা আর যত সমালোচনা-আলোচনা। প্রতিরোধ, প্রতিকার নিয়ে ভাবনা। এই ভাবনা থেকেই সমবায় প্রসঙ্গ।
এবার আলোচনা করা যাক সমবায় নিয়ে। সমবায় কি? সমবায় অতিপ্রাচীন, সুপরিচিত একটি পদ্ধতি। সম্মিলিত উদ্যোগে, সকলের পূজিঁ, মেধা, শ্রম একত্রিত করে বড় উদ্যোগ গ্রহণ করা। দশের লাঠি, একের বোঝা, দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ -এটা সমবায়ের মূলমন্ত্র। সমবায় একটি গণতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। সমবায় সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মান করে। সমবায় সমিতির সকল সদস্য এর মালিক। সদস্যরাই এর পরিচালক আবার শ্রমিক। বিশ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের পুজিঁ, মেধা, শ্রম একত্রিত করে তুলনামূলক বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে। আবার বিশজন ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা পূজিঁ একত্রিত করে একটি মাঝারী শিল্প গড়ে তুলতে পারে। ঠিক ২০ জন মাঝারী শিল্পের উদ্যোক্তা তাদের পূজিঁ একত্রিত করে একটি বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে পারে। সম্মিলিত পূজিঁ, মেধা, শ্রমের মাধ্যমে বৃহৎ শিল্প গড়ে উঠলে তার উৎপাদিত পণ্য দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানীর পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা করা অনেকটাই সহজ হবে। কেবল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্যেই সমবায় নয় কৃষকের জন্যেও। আইল তৈরির মাধ্যমে জমি নস্ট না করে ক্ষুদ্র কৃষকেরা তাদের জমি একত্রিত করে সমবায় খামার গড়ে তুলতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ যেমন কম হবে তেমনি ফসলও বেশি উৎপাদিত হবে। জমির পরিমান অনুযায়ী কৃষকের মধ্যে ফসল বন্টন হবে। সমবায়ী কৃষকেরা বহুজাতিক কোম্পানীর বীজ, সার কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে নিজস্ব উৎপাদিত বীজ, জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারে। আবার সমবায় সমিতিতে নিয়মিত সঞ্চয় জমা করে এক পর্যায়ে মুলধন দিয়ে শস্য মজুদের গোডাউন নির্মাণ এমনকি কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পও স্থাপন করতে পারে। সমবায় খামারের মাধ্যমে কৃষকেরা নিজেদের উদ্বৃত্ত পণ্য মজুদ রেখে নিজস্ব নেটওয়াকের মাধ্যমে বাজারজাত করে মধ্যস্বত্ত্ব ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবে।
এবার সমবায়ের নতুন কাঠামো ও নয়া আন্দোলন প্রসঙ্গ। সমবায় পুরাতন তত্ত্ব হলেও বিশ্বায়ন তত্ত্ব নতুন। বিশ্বায়ন ধারণা থেকে এখন পৃথিবী কে বলা হচ্ছে ‘বিশ্ব পল্লী’। পূজিঁ এখন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছে। পণ্যের অবাধ প্রবাহ। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সারা বিশ্বে তাদের পণ্য বাজারজাত করছে। এমতাবস্থায় বিশ্বের সমবায়ীগণ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। সমবায় এখন দেশ কেন্দ্রিক হতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনে সমবায়ীদের কার্যকর বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। উল্লেখ্য, বহুজাতিক কোম্পানীগুলো উন্নত দেশ কেন্দ্রিক হলেও ঐসব দেশের দরিদ্র মানুষও আগ্রাসনের শিকার। যে কারনে বিশ্বের সকল দরিদ্র মানুষের সমবায়ের মাধ্যমে এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশ, মহাদেশ ছাড়িয়ে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। পাঁচ স্তর (প্রাথমিক সমবায় সমিতি-কেন্দ্রীয় (লোকাল) সমবায় সমিতি, জাতীয় সমবায় সমিতি, মহাদেশীয় সমবায় সমিতি, বৈশ্বিক সমবায় সমিতি) সমবায় কাঠামোর আওতায় বিশ্বের সকল সমবায়ীদের এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিশ্বব্যাপী সমবায়ীদের মধ্যে অর্থ লেনদেনের জন্য বিশ্ব সমবায় ব্যাংক স্থাপন করতে হবে। প্রাথমিক সমবায় সমিতি মিলে যেভাবে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, আবার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক মিলে যেমন জাতীয় সমবায় ব্যাংক, অনুরূপ জাতীয় সমবায় ব্যাংক মিলে গঠিত হবে মহাদেশীয় সমবায় ব্যাংক। ঠিক মহাদেশীয় সমবায় ব্যাংক মিলে গঠিত হবে বৈশ্বিক সমবায় ব্যাংক। বিশ্ব সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের সমবায়ীদের উদ্বৃত্ত অর্থ অনুন্নত বিশ্বের সমবায়ীদের ঋণ হিসেবে প্রদান করা যাবে। বিশ্বব্যাপী সমবায় ব্যবসা ও সমবায় শিল্প উদ্যোগে অর্থায়ন করবে বিশ্ব সমবায় ব্যাংক। এছাড়া খাত ভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় পর্যায়ের সমবায় সমিতি মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক সমবায় সমিতি গড়ে তুলে আন্তঃ রাষ্ট্র লেনদেন করতে পারে।
তবে বিষয়টি যেমন জটিল তেমন কঠিন। কিন্তু খুবই জরুরী এবং সম্ভব। আর এজন্যই নতুন করে সমবায় আন্দোলনের প্রয়োজন। কেননা, পাঁচ স্তর সমবায় কাঠামোর আওতায় সমবায় সমিতির মধ্যে আন্তঃ রাষ্ট্র লেনদেন করার বিধান কোন দেশের আইনেই নেই। তাই সর্বাগ্রে আইনে এই বিষয়টি সংযোজন করা জরুরী। আবার এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বহুজাতিক কোম্পানী, তাদের সুবিধা ভোগী ও সমাজের ধনিক শ্রেণী বিরুদ্ধাচারণ করবে। তাই বিশ্বের সকল সমবায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইন পরিবর্তনের জন্য স্ব স্ব সরকারের প্রতি দাবী তুলতে হবে। বিশ্বের সকল সমবায়ীদের পূজিঁ, শ্রম, মেধা একত্রিত করে বহুজাতিক কোম্পানীর সমান্তরাল সমবায় কোম্পানী গড়ে তুলে কর্পোরেট পূজিঁর ভোগবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ও সম্প্রীতির বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সমবায় গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :
Leave a Reply
More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর