দুগ্ধ চাষিদের জীবনমান উন্নয়ন ও দুগ্ধ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সমবায়ের সম্ভাবনা

দুগ্ধ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্ত ¡ভোগী, ফড়িয়া,দালাল সুদের কারবারি মহাজন শ্রেণী কর্তৃক নিগৃহীত নিষ্পেষিত প্রান্তিক দরিদ্র দুগ্ধ কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করে তাদের গবাদি পশুর দুধের ন্যায্য মূল্য প্রদানে বাজার সৃষ্টি,সমবায়ী ও জনসাধারনকে খাঁটি দুগ্ধ পণ্য সরবরাহের চেতনা থেকেই দুগ্ধ সমবায়ের যাত্রা শুরু। ইউরোপ আমেরিকা সহ বিশে^র অনেক দেশে দুগ্ধ সমবায়ে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।সমবায় ভূমি খ্যাত ডেনমার্ক দুগ্ধ সমবায়ে বিশ^বাসির জন্যে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত দুগ্ধ সমবায়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে দুগ্ধ উৎপাদনে ভারত শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছে দুগ্ধ সমবায়। ভারতে প্রায় ১লাখ ৯০ হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারি সমবায় সমিতি রয়েছে। বিখ্যাত সমবায় ব্রান্ড আমুল প্রায় ১০ হাজার দুগ্ধ উৎপাদন সমবায় সমিতির নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সমবায়ের সুবাদেই ভারত বিশে^র অন্যতম দুগ্ধ পণ্য উৎপাদনকারি দেশ।
ভারতের অনুরুপ দুগ্ধ শিল্পে সম্ভাবনা বাংলাদেশের ছিল বা এখনো আছে। এবং উদ্যেগ নেয়াও হয়েছে। যে উদ্যেগ নেয়া হয়েছিল সরকার-সমবায় অংশিদারিত্বে। কিন্ত নানা কারনে প্রত্যাশিত অবস্থানে যেতে সক্ষম হয়নি। দেশকে দুগ্ধ ও দুগ্ধ পণ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার নিমিত্তে সরকারের উদ্যেগে দুগ্ধ সমবায়ের সূচনা। অবলম্বন করা হয় সরকার-সমবায় অংশিদারিত্ব পদ্ধত্বি। বাংলাদেশে দুগ্ধ শিল্প গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৪৬ সালে। সমবায় ভিত্তিক দুগ্ধ কারখানা স্থাপন শুরু ১৯৬৬ সালে। তবে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায়ীদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লি: যাত্রা শুরু করে ১৯৭৩ সালে। সমিতির প্রডাক্ট ব্রান্ডিং হচ্ছে মিল্কভিটা।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা অধিকাংশ সমবায় সমিতিগুলো যখন মৃত্য ুপথযাত্রী তখন একমাত্র দুগ্ধ সমবায় আশার আলো দেখাচ্ছে। প্রত্যাশিত মাত্রায় না চললেও এবং অনিয়ম , অব্যবস্থাপনা দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও সমিতির কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সমবায়ী দুগ্ধ কৃষকের উৎপাদিত দুগ্ধ এবং দুগ্ধ পণ্য বাজারজাত করছে। মিল্কভিটার প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের দুগ্ধ পণ্যের চাহিদার বৃহৎ অংশের যোগান দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানী এবং দেশীয় কিছু কোম্পানী।
দুগ্ধ সমবায় ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন পর্যন্ত সারা দেশে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারেনি। এপর্যন্ত দেশের মাত্র ৭ বিভাগের ২৫ জেলার ১৩২ উপজেলার ৪৯০ ইউনিয়নের ২৩১৯টি গ্রামে দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম রয়েছে। দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রাথমিক সমবায় সমিতি ৩০৮৪টি এবং সম্প্রতি গঠিত কেন্দ্রীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি ৬২টি। সমিতির সদস্য প্রায় ১,২২,৬০৮ জন। প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী প্রায় ৮ লাখ। সমিতির নিজস্ব জমির পরিমাণ ৯৯.৩০ একর। গো-চারণ ভূমি ১০৩০ একর। সবুজ ঘাস চাষ ২,৫১২ একর। মোট কারখানা ৪৬টি। দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র ৪১টি। প্রক্রিয়াজাত কারখানা ৮টি। অনুমেদিত শেয়ার মুলধন ৭০,০০,০০,০০০ টাকা। অনুমোদিত শেয়ারের সংখ্যা ৭০,০০০টি। প্রতি শেয়ারের নামিক মূল্য ১০,০০০টাকা। সরকারী ইক্যুইটি ৫৪ শতাংশ। সমবায়ীদের অংশগত মূলধন ৪৬ শতাংশ। বর্তমানে তরল দুধ, গুড়ো দুধ সহ মিল্কভিটা প্রায় ১৭টি পণ্য বাজারজাত করছে। অনুমোদিত জনবল ১৩১২জন।
মিল্ক ভিটার বিকাশে অন্তরায় হিসাবে কাজ করছে সমবায়ে রাজনীতিকিকরণ, ব্যবস্থাপনা কমিটিতে অসমবায়ী স্বার্থান্বেষি মহলের অনুপ্রবেশ, কর্মচারী ইউনিয়নের অযাচিত কার্যক্রম, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং ব্যবস্থাপনায় সমবায় ও দুগ্ধ বিশেষজ্ঞ না থাকা। সর্বোপরি জনসাধারনের সমবায় সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ভ্রান্ত ধারনা থাকায় দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম সারা দেশে বিস্তৃত হচ্ছেনা। অভিযোগ রয়েছে মিল্কভিটার কতিপয় অসৎ কর্মচারী পণ্য বাজারজাত না করে গুদামজাত করে রাখে।ফলে বাজার দখল করে বহুজাতিক ও দেশীয় কোম্পানী।এছাড়া,এই অসাধু চক্র মিল্কভিটার ইমেজ নষ্ট করার জন্যে ভেজাল দুগ্ধ সামগ্রী বাজারজাত করে বলে অভিযোগ আছে।
মিল্কভিটার যথাযথ ও ব্যাপক ভিত্তিক কার্যক্রম দেশকে দুগ্ধ পণ্য আমদানীকারক থেকে রপ্তানীকারকে রূপান্তরিত করতে পারে। এজন্যে মিল্ক ইউনিয়নের কার্যক্রম সারা দেশে বিস্তৃত করতে হবে। প্রতিটি গ্রামে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতি গঠন করে সব দুগ্ধ কৃষকদের এক ছাতার নীচে নিয়ে আসতে হবে। অন্তত প্রতি উপজেলায় একটি করে গো-চারণ স্থাপনা ও সবুজ ঘাস চাষ স্থাপনা করতে হবে। এজন্যে চরাঞ্চলে সরকারী খাস জমি লীজ নেয়া হবে উত্তম কাজ। তহবিল সাপেক্ষে ক্রয়ও করা যেতে পারে। গো-খাদ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপন করতে হবে প্রচুর পরিমাণে। আধুনিক পশু প্রজনন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে হবে। মিল্ক ইউনিয়নে রাজনীতিকিকরণ বন্ধ ও অসমবায়ীদের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত দুগ্ধ সমবায়ীদের দ্বারা পরিচালনা কমিটি গঠন করতে হবে। সিবিএ’র কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে পর্যাপ্ত ঋণ ও অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণ নেয়া যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে সমবায় অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে দেশের প্রতিষ্ঠিত সমবায় সমিতির কাছে শেয়ার বিক্রি করে অর্থের যোগান হতে পারে।
তবে দুগ্ধ সমবায় কেবল সরকারি অংশিদারিত্বে প্রতিষ্ঠিত মিল্কভিটার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সারাদেশে ব্যক্তি উদ্যেগে গ্রামে গ্রামে নতুন দুগ্ধ সমবায় সমিতি গড়ে উঠতে পারে। নতুন গড়ে উঠা দুগ্ধ উৎপাদনকারি প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলো বিদ্যমান তিনস্তর কাঠামো অনুসরনে আঞ্চলিক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সমিতি গঠন করতে পারে। আবার কেন্দ্রীয় দুগ্ধ সমবায় সমিতিগুলো জাতীয় দুগ্ধ সমবায় সমিতি গঠন করবে। এভাবে সারা দেশে একাধিক সমবায় দুগ্ধ ব্রান্ড সৃষ্টি হতে পারে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাহিরে গড়ে উঠা সমবায় দুগ্ধ ব্রান্ড সমুহ রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থেকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। সারা দেশে সমবায় দুগ্ধ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্যে সমবায়ীদের পাশাপাশি সমবায় অধিদপ্তরকে উদ্যেগ গ্রহন করতে হবে। কেবল সমবায়ের মাধ্যমেই দরিদ্র প্রান্তিক দুগ্ধ কৃষকদের মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালদের নিষ্পেষনের হাত থেকে রক্ষা করে তাদের জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব। কেননা, সমবায় হচেছ গণতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। নিজেদের জন্যে নিজেদের দ্বারা পরিচালিত। সদস্যরাই সমবায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। সদস্যদের শেয়ারের পরিমান কম বেশি যাই হোক অধিকার সমান। এক সদস্য এক ভোট নীতি। যে নীতি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনুসরন করা হয়না।সমবায়ে কেউ কাউকে শোষন করতে পারেনা। শোষন করার সুযোগ নেই। এখানে সবাই মালিক কেউ কর্মচারী নয়। সমবায় নিজেকে নিজে পরিচালনা করতে শেখায়। সমবায় উদ্যেক্তা হতে উৎসাহ যোগায়।সমবায় বৈষম্যহীন সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মান করে।
দুগ্ধ শিল্পে বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে ভারতের ন্যায় সমবায় দুগ্ধ শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দুগ্ধ চাহিদা পুরন করে বিদেশে দুগ্ধ পণ্য রপ্তানীও করতে সক্ষম হবে।
লেখক:সাংবাদিক ও সমবায় গবেষক