দারিদ্র বিমোচনে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ

বিভিন্ন যুগে, কালে ও শতাব্দীতে কোন একটি বিষয় বা ব্যক্তি আলোচিত তত্ত্ব বা চরিত্রে পরিনত হয়। তেমনি গত শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত তত্ত্ব হচ্ছে হচ্ছে ‘‘ক্ষুদ্র ঋণ’’। ক্ষুদ্র ঋণের ‘‘মহত্ব’’ বিশ^ ম্যাস মিডিয়াতে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণের বিশ্ব সম্মেলনও হয়েছে। আশ্বচর্যের বিষয় হলো তা আবার অনুষ্ঠিত হয়েছে পুঁজিবাদের ধারক বাহক এবং কর্পোরেট পুঁিজর অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে! এর কারণ এই নিবন্ধে আলোচনা করবো না। এখানে দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণ এবং সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো।
ক্ষুদ্র ঋণ আসলে নতুন কোন তত্ত্ব নয়। বৃটিশ ভারতেও ক্ষুদ্র ঋণের প্রচলন ছিল। তাছাড়া বিশ্বে সমবায় সমিতির যখন আবির্ভাব তখন থেকেই ক্ষুদ্র ঋণের সূচনা। মানব সভ্যতার সুতিকাগার ইউরোপে এখন থেকে আড়াই ’শ বছর আগে সমবায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। যে কারণে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক দাবি করতে পারে না। কেউ হয়তো ক্ষুদ্র ঋণের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো বা মডেল উদ্ভাবন করতে পারেন। ক্ষুদ্র ঋণের ‘‘মহত্ত্ব’’ এনজিও’র সুবাদে বেশি মাত্রায় প্রচার পাচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণের মহত্ত্বের প্রচারকদের দাবি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও ধনী গরীবের বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব। কেউতো আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে ‘‘দারিদ্র কে জাদুঘরে’’ পাঠানো সম্ভব হবে। বিষয়টি যে গানের চেয়ে বাজনা বেশী মার্কা প্রচারনা তা কোন বোধ শক্তি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে বুঝা কষ্ট হবে না। প্রকৃত পক্ষে সুদযুক্ত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন বা বৈষম্য হ্রাসকরন সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে অলটারনেটিভ ব্যাংক। অন্যকথায় আধুনিক কাবলিওয়ালা বা মহাজনী সুদের কারবারির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। বিশেষত্ব হচ্ছে দরিদ্র মানুষ জামানত ছাড়া এখানে ঋণ পায়। যা প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় পায় না। কিন্ত ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহকদের চড়া সুদের মাসুল দিতে হয়। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার চেয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সুদের হার অনেক বেশি।
তবে হ্যাঁ। দারিদ্র বিমোচনে, ধনী-গরীব বৈষম্য হ্রাসে ক্ষুদ্র ঋণ ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভূমিকা রাখতে পারে। ঋণ যেমন ক্ষুদ্র ভূমিকাও তেমন ক্ষুদ্র। দারিদ্র কে জাদুঘরে পাঠানোর মত ক্ষমতা নিশ্চয়ই ক্ষুদ্র ঋণের নেই। যদি না তার হাতে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ থাকে। দারিদ্রতার কারণ ভিন্ন আর তা দূরীকরনের পন্থাও ভিন্ন। তা নিয়ে বিস্তারিত অন্যত্র আলোচনা করার আশা রাখি।
এখন বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণ ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখে। দরিদ্র মানুষের স্বাবলম্বিতা অর্জনে কিছুটা ভুমিকা রাখে- তাহলে এই তত্ত্বের এত সমালোচনা কেন। সমালোচনা কি ক্ষুদ্র ঋণের নাকি ঋণ প্রদানের পদ্ধতির? অবশ্যই দোষটি ক্ষুদ্র ঋণের নয় দোষ হচ্ছে পদ্ধতির। বাংলাদেশে প্রধানত: এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর এই এনজিওগুলোকে সমালোচকগন ‘‘ আধুনিক কাবলিওয়ালা’’ বলে অভিহিত করেন।
এনজিওগুলোকে কাবলিওয়ালা বলা হয় তাদের কর্মকান্ডের কারনেই। এনজিওগুলো দারিদ্র বিমোচনের নামে বিদেশী বা দেশী দাতা সংস্থা থেকে দান অনুদান অথবা সরকারের নিকট থেকে সল্প সুদে ঋন নিয়ে তা উচ্চ সুদে গরীব মানুষকে ঋণ প্রদান করে। ঋণের সুদের হার প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশী। এনজিও গুলোর সুদের হার ক্ষেত্র বিশেষ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আদায়ের পদ্ধতিও কঠিন। কোন কারণে দরিদ্র ঋণ গ্রহীতা যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে তাদের গরু ছাগল, ঘরের টিন, মহিলাদের অলংকার পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। ঋণ গ্রহীতার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে ‘‘ দরিদ্রদের মুক্তির দূত’’ এনজিওগুলো এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরন করেন। ঋণ আদায়ে এনজিওগুলো সন্ত্রাসী পর্যন্ত ব্যবহার করে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকের স্ত্রীকে এনজিও কর্মকর্তা কর্তৃক বন্ধক চাওয়া এবং সম্ভ্রম বাঁচাতে ঋণ পরিশোধের জন্য কিডনি বিক্রি করার ঘটনাও ঘটেছে বাংলাদেশে। পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকা ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী এনজিওগুলোর অফিস অনেক বিলাসবহুল, অনেক দামী গাড়ী তারা ব্যবহার করেন। কোন কোন এনজিও’র কর্মকর্তাদের বেতন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশী। যে কারণে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে ‘‘দারিদ্র বিমোচনের মিশনারী’’ এনজিওগুলো কি দারিদ্র বিমোচনের জন্য কাজ করছে নাকি দরিদ্র মানুষকে তাদের ব্যবসার উপকরন বানিয়েছে? নাকি দারিদ্রতা কে তাদের জীবিকা বানিয়েছে?
মূল কথা হচ্ছে, ক্ষুদ ঋণ দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও দারিদ্র বিমোচন করতে চাইলে ঋণের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বল্প সুদ বা সহজ আদায় পদ্ধতি খুব একটা কার্যকর হবে না। তবে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম এক্ষেত্রে যথাযথ হবে। সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ খয়রাতি সাহায্য যেমন নয় তেমনি প্রচলিত অর্থে ঋণও নয়। এটা দাতা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ফেরতযোগ্য ধার স্বরূপ। যাতে দাতা প্রতিষ্ঠানের তহবিল ঘাটতি হবে না আবার ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাকে সুদের বোঝা বহন করতে হবে না । সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে উৎপাদনমূলক, আয় বর্ধক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে কিছুটা হলেও স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারবে। নির্দিষ্ট সময়ে আবার গ্রহীতা ঋণ ফেরত দিয়ে দিবে। ঐ ঋণ আবার দাতা প্রতিষ্ঠান অন্য গ্রাহককে দিতে পারবেন। এতে দাতা প্রতিষ্ঠানের তহবিলও ঠিক থাকলো। তবে যেসব এনজিও নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদানে বাধ্য করা যায় না। কিন্তু যেসব এনজিও দাতা সংস্থা থেকে দান অনুদান নিয়ে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদানে নীতিগত ভাবে বাধ্য করা যায়। ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা ব্যয় তাদের অন্যসূত্র বা আয় থেকে বহন করতে হবে।
তবে বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশের সরকারেরই প্রধানত: দায়িত্ব হচ্ছে তাঁর দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করা। তবেই সরকার এনজিওগুলোকে সুদ ম্ক্তু ঋণ প্রদানে বাধ্য করতে পারে। অনুন্নত বা কথিত উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের প্রয়োজনে সুদম্ক্তু ঋণ প্রদানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের লিবিয়ায় (গাদ্দাফির শাসনামলে) ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষা বা বিদেশে শিক্ষা গ্রহনের জন্য সুদ মুক্ত ঋণ প্রদান করা হতো। এমনকি বিবাহ করার জন্য তরুনদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করা হতো। নির্দিষ্ট সময় না থাকলেও রাষ্ট্রকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক তার নাগরিকদের বিশেষ অবস্থা বা দুর্যোগকালীন ছাড়া খয়রাতি সাহায্য না দিয়ে ফেরতযোগ্য ঋণ প্রদান করা উত্তম। এতে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের দায়বদ্ধতার জন্ম দেয়। রাষ্ট্রের প্রতিও তারা কর্তব্যপরায়ন হয়। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরিদ্র নাগরিকদের জন্য সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। যেমন কর্মসংস্থান ব্যাংক,যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ব অন্যান্য ব্যাংকও অনুরূপ কর্মসূচী গ্রহন করতে পারে। কৃষি ব্যাংক, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন,ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও কৃষি দপ্তরসমূহ কৃষকদের মাঝে সুদ মুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করতে পারে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে পারে। এ রকম সরকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও প্রয়োজনে সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করতে পারে। বিশেষ করে পিকেএসএফ সরাসরি সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে পারে। তারা সামান্য সুদে এনজিওকে ঋণ প্রদান করে। আর এনজিওগুলো এই ঋণ নিয়ে গ্রাহকের মাঝে ২৫-৩০ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদান করে। পিকেএসএফসহ সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সরাসরি সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করলে এনজিওগুলো জনসাধারনকে ক্ষুদ্র ঋণের নামে শোষণ করার সুযোগ পাবেনা। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা ও কর্পোরেট হাউস তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচীর আওতায় সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। দেশে ইতিমধ্যে একটি বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানী একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে সুদমুক্ত ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাও করছে। এই দৃষ্টান্ত অনুসরন করে অন্যান্য বৃহৎ কোম্পানীগুলো একটি প্রকল্পের মাধ্যমে অনুরূপ সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। দেশি-বিদেশি অনুদানে পরিচালিত এনজিওগুলো সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। সর্বাগ্রে সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমুহের সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
আসলে দারিদ্রতা নির্ণয়ের সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। দারিদ্রতার অর্থ দেশ কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে বিশ্ব ব্যাংক,আইএমএফ,এডিবি সহ দাতাসংস্থাগুলো দারিদ্রতার মাপকাঠি নির্ণয় করে দেয়। তাদের ঋণগ্রহীতা দরিদ্র দেশগুলো আরোপিত সকল মাপকাঠি মানতে বাধ্য হয়। প্রকৃত কথা হচ্ছে, দারিদ্র বিমোচনের পথ ও পন্থা দীর্ঘ এবং ব্যাপক। এটা একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। কেবল সুদমুক্ত ঋণ কার্যক্রমে পুরোপুরি দারিদ্র বিমোচন হবে না তবে দারিদ্র বিমোচনের প্রক্রিয়া তরান্বিত করবে। কৃত্রিম বৈষম্য হ্রাস,কর্মসংস্থান সৃজন,আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে-এটা নি:সন্দেহে বলতে পারি।
ৃ