আর্তমানবতার সেবায় আর্ন এন্ড লিভ

গৃহহীন আদম সন্তান খোলা আকাশের নিচে শীতের রাতে ফুটপাতে নিদ্রা যায়। ঘন কুয়াশা আবৃত শীতে কাতরায়। গভীর রাতে শীতার্তদের গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয় মানবতাবাদী স্বেচ্ছাসেবক টীমের সদস্যরা।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের পুঁটিয়া গ্রামের দিনমজুর আনোয়ার হোসেনের ছেলে আলামিন হোসেন জীবন (১৮) জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। বয়স ১৮ বছর হলেও বাবা দিনমুজুর হওয়াতে একটি হুইল চেয়ার কিনতে পারেন নাই। প্রতিবন্দী আলামিনকে সব সময় উঠানে, মেঝেতে আর চকিতেই শুয়ে মানবেতর জীবন যাপনে দিন কাটাতে হচ্ছিলো। একটি নতুন হুইল চেয়ার আলামিনের জন্যে ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা মুছাপুর ইউনিয়নের অসহায় কয়েকটি পরিবার। একটি টিউওয়েলের অভাবে আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, অন্যের বাড়ি থেকে, পানি আনতে হতো তাদের। এখন আর তাদের কষ্ট করতে হয়না। সংস্থাটি তাদের একটি টিউবওয়েল’র ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
হতদরিদ্র শাকিল জটিল কিডনি রোগে আক্রান্ত। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। কিডনি রোগী শাকিলকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিল। প্রতিবন্ধীরা যেন পরিবার ও সমাজের বোঝা না হয় সে লক্ষ্যে সংগঠনের স্বাবলম্বী প্রজেক্টের আওতায় টাঙ্গাইল জেলার সোহাগ পাড়া বাজারের কিডনি রোগী শাকিলকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা করেছে মানব কল্যানে ব্রত সংস্থাটি। আর এরকম হতভাগ্য অসহায় মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সর্বদা নিরলস প্রচেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।
অপরদিকে লতা খাতুন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ভাসুরকে কাধে নিয়ে ভিক্ষা করেছেন, কখনো অন্যের বাড়ি কাজ করেছেন। দিন মজুর স্বামি ও প্রতিবন্ধী ভাসুর কে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছিলেন লতা খাতুন। একদিন ঘরের দরজায় ত্রান কর্তা হাজির। আমরাও পারি-এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সংস্থার স্বাবলম্বী প্রজেক্টে এর আওতায় সহায়তা করলো লতা খাতুন-কে। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার সুবিধা বঞ্চিত অসহায় নারী লতা খাতুনকে স্বাবলম্বী করতে সংস্থার পক্ষ থেকে দেয়া হলো দুটি ছাগল। সংস্থার অনুদানে প্রতিবন্ধী লতিফের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থাও হয়েছে। প্রতিবন্ধী লতিফের ঘুমানোর জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহ একটি খাটের ব্যবস্থাও করা হয়। এবং বাঁক প্রতিবন্ধী এই বৃদ্ধের যেন আর ভিক্ষা বৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতে না হয় এ জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে তার ভরন পোষণের দায়িত্ব নেয়া হয়।
অন্যদিকে সহায় সম্বলহীন অসহায় একটি পরিবার। বড় ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। অপরদিকে তালাক প্রাপ্ত হয়ে তাদের সংসারে ফিরে এসেছে এক বোন। তার ওপর নিজের পরিবার। এমতাবস্থায় এরশাদ দিশেহারা। পরিবারের সকলের আহার যোগাতেই তার অনেক কষ্ট হয়। ঘরের দিকে তাকানোর সুযোগ কোথায়। অথচ পরিবারের সকলের থাকার একটি মাত্র ঘর। অনেক কষ্ট করে এক ঘরেই তাদের থাকতে হয়। তার ওপর আবার বর্ষায় পানি পরে, ঝড়ে হেলেদুলে পড়ে। যেন ”আসমানী’র” কুটির। যে কোন সময় ঘরটি ভেঙ্গে পড়লে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নাই। এমতাবস্থায় বিষয়টি নজরে আসে সংস্থাটির। উদ্যোগ নেন এরশাদের পাশে থাকার। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের এরশাদ মিয়ার পরিবারের প্রতি। নির্মাণ সামগ্রী কেনা হতে তদারকি এবং রক্ষনাবেক্ষন করেন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকগণ। অনেক স্বেচ্ছাসেবক কর্মী নির্মান কাজে অংশ গ্রহন করে কাঁধে কাঁধ রেখে গড়ে তুলেন এরশাদের পাকা ঘর। এই মহত কর্মে অংশ নেন স্থানীয়রাও। ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করে ঘরটি বুঝিয়ে দিতে আয়োজন জন করা হয় দোয়া মাহফিলের। এ সময় সংস্থার দেওহাটা শাখার পক্ষ হতে এরশাদ মিয়ার পরিবারসহ স্থানিয়দের বিরিয়ানী ও মিষ্টি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। আয়োজনের পর ঘরটি পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত এরশাদ ও তার পরিবার। অশ্রু শিক্ত নয়নে বার বার শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন মহান রাব্বুল আল আমিনের দরবারে। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন সংগঠনের প্রতি। চোখের জল মুছতে মুছতে এরশাদের স্ত্রী বলেন, আমার সবজী বিক্রেতা স্বামীর পক্ষে খাবার যোগাড় করতে গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করার সুযোগ হত না। এই ঘরটি পাওয়ায় ছেলে-মেয়ে পরিবারকে নিয়ে থাকতে পারবো।
আবার জয়দেবপুরের প্রতিবন্ধী শামিমা প্রতিভা থাকা সত্ত্বে আর্থিক সমস্যার কারনে লেখা পড়া করতে পারছিলেন না। তার কাছেও এসে হাজির সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক টিম। শামিমা এই সমাজেরই একজন যে প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে ইংলিশে অনার্স পড়ছে। আবার ভাই বোন দুজনেই প্রতিবন্ধী। শামিমাকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করার জন্যে সংস্থার পক্ষ থেকে দেয়া হলো দোকান ঘর। শামিমা ধরলো সংসারের হাল। অন্যদিকে শামিমার প্রতিবন্ধী ভাই-কে দেয়া হলো হুইল চেয়ার। পরিবারের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কেবল শাকিল,লতা,শামিমা বা এরশাদ নয়; এভাবে দেশের আনাচে কানাচে পড়ে থাকা হতদরিদ্র,সমস্যাগ্রস্ত, অসহায় মানুষের পাশে এসে দাড়ায় সংস্থাটি।
উপরে বর্নিত তথ্য আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত সংস্থা আর্ন এন্ড লিভ-এর। হ্যা,উপরোক্ত মানব সেবার মহৎ কাজগুলো সম্পাদন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর্ন এন্ড লিভ। এখানে সংস্থার সেবামুলক কার্যক্রমের ক্ষুদ্রাংশ মাত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এই মহত উদ্যেগের নেপথ্য কারিগর ফরিদা ইয়াসমিন জেসী। মানবদরদী এই নারী সুদুর যুক্তরাজ্য থেকে সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর্ন এন্ড লিভ-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন জেসী’র সুদক্ষ নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবকরা ছড়িয়ে পড়ছেন দেশের আনাচে কানাচে। খুঁজে বের করছেন সমস্যাগ্রস্ত মানুষদের। অন্নহীনে অন্ন দান,বস্ত্রহীনে বস্ত্র দান,গৃহহীনে গৃহ দান,রোগাগ্রস্তকে চিকিৎসা দান আর্ন এন্ড লিভের স্বেচ্ছাসেবকদের রুটিন ওয়ার্ক। বিশেষ সেবা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আর্ন এন লিভ ফাউন্ডেশন স্পেশাল নিড্স স্কুল,ফিজিও থেরাপি সেন্টার, মেডিকেল ক্যাম্প ও বিশুদ্ধ পানির জন্যে টিউবওয়েল স্থাপন। এছাড়া,মসজিদ-মাদ্রাসার জন্যে বিশেষ অনুদান প্রদানও আর্ন এন লিভ এর রুটিন ওয়ার্ক। তাছাড়া,বৃদ্ধনিবাস স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি।
প্রতিবন্ধী,হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষের আস্থার প্রতীক আর্ন এন লিভ। আর্ন এন্ড লিভ-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফরিদা ইয়াসমীন জেসী দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা সহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত প্রতিবন্ধীদের নানা ভাবে সহায়তা করে আসছেন। অবশ্য আর্ন এন্ড লিভ-এর কার্যক্রম বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে এখন ভারতের আসাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।
উল্লেখ্য,আর্ন এন্ড লিভ’ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক এবং সহায়ক পরিবেশ সরবরাহ করে, তাদেরকে বিশেষজ্ঞের সহায়তায় ব্যবহারিক জীবন দক্ষতা বিকাশে সক্ষম করে। এটি একটি প্রশিক্ষণ ভিত্তিক সংগঠন যা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষ এবং তাদের পরিবারকে আর্থিক স্বচ্ছলতার পথ দেখাতে সহযোগিতা করে থাকে। সংস্থার কর্মপদ্ধতি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন এখানে প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের মতো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষরাও তাদের দক্ষতার অন্বেষণ করতে সক্ষম হন। নিজের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পেয়ে, নিজের পছন্দের ক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করতে সক্ষম হন।